জামান হোটেলের তিন কর্ণধার- ছোট ভাই নুরুজ্জামান, বড় ভাই মালেকুজ্জামান এবং মেজ ভাই মোহা'ম্ম'দ জামান
মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে চলে গেলেন সহোদর তিন ভাই- এর মধ্যে দুই ভাই মাত্র একদিনের ব্যবধানে। এমন ট্রাজিক মুহূর্ত অ'পেক্ষা করছিল যাদের জন্য, সেই তিনজনের হাতেই তিল তিল শ্রমে গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রামের নামি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্যাফে জামান বা হোটেল জামান। গত ২ জানুয়ারি প্রথমে মা'রা যান মেজ ভাই মোহা'ম্ম'দ জামান। ক্যান্সারে এই ভাইটি মা'রা যাওয়ার পর জামান পরিবারে এলো করো'নার থাবা। করো'নার কাছে হেরে মাত্র একদিনের ব্যবধানে মা'রা গেলেন বাকি দুই ভাই- ২১ জুন প্রথমে ছোট ভাই নুরুজ্জামান এবং ২৩ জুন বড় ভাই মালেকুজ্জামান। জামান পরিবারে ৮৫ বছরের একটি অধ্যায় এভাবেই শেষ হয়ে গেল।
ছোট ভাই নুরুজ্জামানের মৃ'ত্যুর একদিন পর বড় ভাই মালেকুজ্জামানেরও মৃ'ত্যু হয় করো'নায়। কিন্তু তাদের একে অ'পরের বাসার দূরত্ব অনেক। ছোট ভাই নুরুজ্জামান লালখানবাজার বাঘঘোনার জামান ভবনের বাসিন্দা। অন্যদিকে বড় ভাই মালেকুজ্জামানের বাসা দক্ষিণ খুলশী মুরগির ফার্ম এলাকায় জামান ভবনে। ঘটনাক্রমে দুই ভাইকে একই দিন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাসপাতালে। তখন তাদের মুখে ছিল অক্সিজেন লাগানো। দুই ভাই একে অ'পরকে দেখেছেন। কিন্তু কথা বলতে পারেননি। কারণ তখন দুজনেই ছিলেন করো'না আ'ক্রা'ন্ত।
এর আগে গত ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর আল ফালাহ গলির নিজ বাসভবনে মা'রা যান মেজ ভাই মোহা'ম্ম'দ জামান। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হোটেল জামান অ্যান্ড বিরানী হাউসের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন তিনি। মৃ'ত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দুই ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন তিনি।
জামান পরিবারে এরপর এলো করো'নার থাবা। টানা ১৭ দিন করো'নাভাইরাসের স'ঙ্গে লড়ে গত ২১ জুন ঢাকা আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা'রা যান ক্যাফে জামানের মালিক নুরুজ্জামান (৬৫)। তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট।
অন্যদিকে এর মাত্র মাত্র একদিন পর ২৩ জুন চট্টগ্রামের সার্জিস্কো'প হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৫ বছর বয়সে মা'রা যান হোটেল জামানের আরেক মালিক মালেকুজ্জামান। পরিবারে তিনি ছিলেন সবার বড়।
এমন একটি পরিবারে কীভাবে ঢুকলো করো'নার বি'ষ, যার কবলে পড়ে পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন সদস্য মাত্র একদিনের ব্যবধানে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হল- এ প্রশ্ন বাইরে যেমন, পরিবারের ভেতরেও সবাইকে ভাবাচ্ছে।
জামান পরিবারে বিভিন্নজনের স'ঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করো'না সংক্রমণের ঝুঁকি থাকার পরও বড় ভাই মালেকুজ্জামান নিয়মিত বাজারে যেতেন। বাজার থেকেই করো'নার সংক্রমণ হয়েছে বলে ধারণা করছেন তার মেজ ছেলে সেলিম জামান। তিনি বলেন, বাবা নিয়মিত বাজার করতে যেতেন। মসজিদেও যাওয়া-আসা ছিল তার। এই দুই জায়গা থেকে আমা'দের ঘরে করো'না ঢুকে থাকতে পারে।
বাবার পর সেলিম জামানের বড় ভাই সেকান্দর জামান ও তার মেয়ে এবং ছোট ভাই মামুন জামানও করো'না পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। আ'ক্ষেপ করে তিনি বললেন, এই ভাইরাস আমা'দের জীবনকে ধ্বং'স করে দিয়েছে।
সেলিম জামান বলেন, বাবার একটু জ্বর হয়েছিল রমজানের শেষের দিকে। একসময় জ্বর কমেও যায়। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিলেন না তিনি। ঈদের পর করো'না পরীক্ষা করিয়ে দেখি পজিটিভ এসেছে। তখন নগরীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখান থেকে একটু সুস্থ হওয়ার পর তাকে বাসায় নিয়ে আসি। কিছুদিন পর হঠাৎ করে শ্বা'সকষ্ট শুরু হয় তার। জুন মাসের প্রথম স'প্তাহে তাকে আবার হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে প্রায় এক স'প্তাহ থাকার পর অবস্থা যখন আরও খারাপ 'হতে থাকে, তখন আইসিইউ সা'পোর্ট নিয়ে বাবাকে সার্জিস্কো'পে ভর্তি করাই। ওখানে ৬ দিন থাকার পর আবার বাসায় নিয়ে আসি।
তিনি বলেন, সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। বাবাকে সুস্থ মনে করে আমর'াও বাসায় আনতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু ২৩ জুন আবার শ্বা'সকষ্ট শুরু হয় বাবার। তখন তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তখন আর আমর'া আইসিইউ পেলাম না। ফলে বাবাকে আর রাখতে পারলাম না। সেদিনই মা'রা গেলেন তিনি।
চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ খুলশী মুরগির ফার্ম এলাকায় জামান ভবনে বসবাস করে পরিবারের বড় সন্তান মালেকুজ্জামানের পরিবার। মালেকুজ্জামানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। এরা হলেন সেকান্দর জামান, সেলিম জামান, আলমগীর জামান, খোকন জামান, মামুন জামান এবং মেয়ে বেবী জামান।
মেজ ভাই মোহা'ম্ম'দ জামানের পরিবারের বসবাস নগরীর আল ফালাহ গলির জামান ভবনে। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এরা হলেন কায়সার জামান, ছোটন জামান, মেয়ে রোখসানা পারভীন, সাবিনা ইয়াসমিন ও রেহে'না পারভীন মুন্নি।
অন্যদিকে ছোট ভাই নুরুজ্জামান লালখানবাজার বাঘঘোনার জামান ভবনের বাসিন্দা। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা হচ্ছেন সাকিলা জামান রুবী, সালমা জামান রুণী, সাহেদ জামান ও সাজিদ জামান।
লালখানবাজার বাঘঘোনার বাসিন্দা নুরুজ্জামানের ছেলে সাহেদ জামান বলেন, ‘ঈদের দিন বাসার পাশে একজন করো'না রোগী মা'রা যান। তার জানাজায় গিয়েছিলেন বাবা। আমা'দের ধারণা, সেখান থেকেই আমা'দের বাসায় হানা দিয়েছে করো'না। এখন আমা'র ছোট ভাই সাজিদ জামান ছাড়া আমর'া সব ভাইবোন করো'না পজিটিভ।’
তিনি বলেন, ‘বাবা যদি ওই করো'না রোগীর জানাজায় না যেতেন তাহলে হয়তো আমর'া বেঁচে যেতাম। বাবাও জানতেন না ওই লোক করো'না আ'ক্রা'ন্ত ছিলেন। জানাজা শেষে দা'ফনের পর জানতে পারেন ওই লোক করো'না পজিটিভ ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। বাবার পরপর আমর'াও করো'নায় আ'ক্রা'ন্ত হই। এখন ঘরেই আমা'দের চিকিৎসা চলছে।’
মৃ'ত্যুর পর দুই ভাইকে গ্রামের বাড়ি রাউজানের কোতোয়ালী ঘোনার কাসেম ফকির বাড়ির একই কবরস্থানে দা'ফন করা হয়। এর আগে জানুয়ারিতে মৃ'ত্যুবরণ করা মেজ ভাইকে দা'ফন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম নগরীর চশমা হিল কবরস্থানে।
সূত্র: চট্টগ্রাম প্রতিদিন
Leave a Reply